Menu |||

বৈশাখে ইলিশ খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়, এটা স্রেফ শহুরে ফ্যাশন

আদিত্য আরাফাত::  ইলিশকে উড়ে এনে জুড়ে বসানো হয়েছিলো যেনো বাঙালির সার্বজনীন বৈশাখ উদযাপনে! যদিও বৈশাখে ইলিশ বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়। তবুও নববর্ষ পালনে বাঙালির পাতে যেনো জোর করে চাপানো হয় ইলিশ।

বৈশাখে ইলিশ ভোজনকে যখন বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ বানিয়ে ফেলা হয় তখন অসময়ে শুরু হয় এ মাছটি কেনার মহোৎসব। চাহিদা বেশি থাকায় নির্বিচারে শুরু হয় ইলিশ ধরা। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে প্রজননকালে ইলিশ নিধন হতে থাকে।

এতে সারাবছরে ইলিশ উৎপাদনে প্রভাব পড়ে। এভাবে বৈশাখকে কেন্দ্র করে ইলিশ ধরার উৎসব চললে নিকট অতীতে জাতীয় এ মাছটি হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কাও তৈরি হয়।

এমন শঙ্কার মাঝে কথা উঠে ইলিশ বৈশাখী সংস্কৃতিতে কিভাবে আসলো। হাজার বছরের যে বাঙালি সংস্কৃতি তাতে বৈশাখ পালনে ইলিশ খাওয়া হতো কি-না! বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহকরা ইতিহাস ঘেটে দেখেছেন, নববর্ষ উদযাপনে ইলিশ ভোজন হতো না। নথিপত্র ঘেটে গভীর অনুসন্ধানে তারা দেখেছেন, বৈশাখে ইলিশ খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়। এটা স্রেফ শহুরে ফ্যাশন। নিকট অতীতেই এ ফ্যাশন চালু হয়।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এতোবছর ধরে বাংলা নববর্ষে ইলিশ খাওয়ার রীতি চালু থাকলেও এবার কেন ‘বৈশাখে ইলিশ নয়’ এ কথা উঠছে। মৎস্য গবেষকরা বলছেন, বৈশাখকে কেন্দ্র করে নির্বিচারে শুরু হয় ইলিশ ধরা। ইলিশ মাছ বছরজুড়ে কমবেশি ডিম ছাড়লেও ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল অব্দি ছোট ডিম ছাড়ার পর্ব থাকে।

আর এ সময়ে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে আগে থেকে ছানা ইলিশ নিধন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এভাবে চলতে থাকলে শিগগিরই ইলিশ বিলীন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন গবেষকরা। নদীতে ইলিশের সংখ্যা যেভাবে কমছে তাতে শঙ্কিত হয়ে ঝাটকা না ধরতে পরামর্শ দিয়েছেন। এতো গেলো মৎস্য গবেষকদের কথা।

আর সংস্কৃতি বোদ্ধারা নথিপত্র ঘেটে বলছেন, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশের দূরতম সম্পর্ক নেই। পান্তা ভাতের সঙ্গেও বৈশাখী উৎসবে বাঙালি সংস্কৃতির মিল নেই। প্রান্তিক মানুষরা পান্তাভাত খান স্রেফ নুন আর মরিচ দিয়ে। ইলিশ মাছ তাদের কাছে সাধ্যাতীত বস্তুতুল্য। তাদের সারা দিনের কামাই দিয়ে স্বাভাবিক সময়ে একটা জাটকা মেলে না, পহেলা বৈশাখে ইলিশের স্বপ্ন দূর অস্ত। তাই অনেকে পহেলা বৈশাখের পান্তা-ইলিশকে দেখছেন বাঙালির প্রান্তিক মানুষের প্রতি উপহাস ও ব্যঙ্গ হিসেবে।

সমাজবিজ্ঞানী, সংস্কৃতি বোদ্ধা এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বৈশাখে ইলিশের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সম্পর্ক নেই। পান্তাভাত গরিব মানুষের খাবার। রাতে খাওয়ার পর অবশিষ্ট ভাত রাখার কোনো উপায় ছিল না; তাই পানি দিয়ে রাখা হতো এবং সকালে আলুভর্তা, পোড়া শুকনো মরিচ ইত্যাদি দিয়ে খাওয়া হতো। আমিও ছোটবেলায় খেয়েছি। কিন্তু এখন পান্তা-ইলিশ ধনী লোকের বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে এবং এটা দুর্মূল্যও বটে—যা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এর মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতিকে সম্মান দেখানোর পরিবর্তে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। পান্তাভাত একদিন নয়, সারা বছরই খাওয়া যেতে পারে।

তিনি বলেন, আমাদের ছোটবেলায় পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার প্রচলন ছিল না। আমরা চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় যেতাম এবং বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনতাম। পহেলা বৈশাখে হালখাতার অনুষ্ঠানে যেতাম। তখন এসব অনুষ্ঠান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।

এর মধ্যে কোনো বাণিজ্যিকতা ছিল না। কিন্তু এখানে বৈশাখী অনুষ্ঠানে বাণিজ্যিকতা ঢুকেছে এবং বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে বড়লোকের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, ঢাকার শহুরে বাঙালিদের কেউ কেউ আগপিছ না ভেবে আচমকা পান্তা-ইলিশের চল শুরু করেছিলেন আশির দশকে। ১৯৮৩ সালে ওই বছরই প্রথম রমনা এলাকায় একটি বাণিজ্যিক পান্তাভাতের দোকান দেওয়া হয়। সেই দোকানে অভিনবত্ব আর নাগরিক আভিজাত্য আনতে পান্তার সঙ্গে পরিবেশন করা হয় ভাজা ইলিশের টুকরো।

দোকানের সামনে ব্যানার টাঙ্গিয়ে লেখা হয়, ‘এসো হে বৈশাখ…বৈশাখে পান্তা-ইলিশ ভোজন’। বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হলে অনেকেই পরে তার পেছনে ছোটে। অতএব, এর পর থেকে পান্তা-ইলিশের দোকানের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়তে থাকে। আশির দশকে শহুরে সংস্কৃতিতে পান্তা ইলিশ চালু হলেও নব্বই দশক থেকে এর ব্যাপকতা বাড়ে।

এক পর্যায়ে নববর্ষে পান্তা-ইলিশের ব্যবসা বেশ জেঁকে বসে। মেঘনার অবৈধ ইলিশ শিকারি আর শহরের ফড়িয়া ব্যবসায়ী সবাই পহেলা বৈশাখ ঘিরে ইলিশকেই গড়ে তুলল ব্যবসার প্রধান অনুষঙ্গ। ইলিশের দাম শতকের ঘর ছাড়িয়ে হাজারের ঘরে উঠে গেল।

কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, ইলিশ আমাদের ঐতিহ্যের অংশ তবে বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার রীতি বাঙালি সংস্কৃতিতে ছিলো না। আর পান্তা গ্রামবাংলায় কৃষকের প্রতিদিনেরই খাবার। কিন্তু পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার প্রচলন তাদের মধ্যে নেই।

তিনি বলেন, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লেষহীনতা ছাড়াও এই পান্তা-ইলিশের হেঁয়ালি প্রভাব ফেলছে দেশের ইলিশের বংশবৃদ্ধির ওপর। সময়টা ইলিশের প্রজনন মৌসুম। কিন্তু উচ্চমূল্যের লোভে অনেক ব্যবসায়ী লুকিয়ে ইলিশ শিকার করে ক্ষতির মুখে ফেলছে দেশের এই অনন্য মৎস্যসম্পদকে। Panta_Ilish-650x410এ বছরই পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে ‘বৈশাখে ইলিশ নয়’ স্লোগান জোরালোভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী জাতীয় মাছ ইলিশ রক্ষার স্বার্থে নববর্ষ উদ্‌যাপনের দিন অর্থাৎ পয়েলা বৈশাখ ১৪২৩-এর খাদ্যতালিকায় ইলিশের কোনো আইটেম রাখছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে এ দিনের মেন্যুতে খিচুড়ির সঙ্গে থাকছে বেগুন ভাজি, ডিম ও মুরগির মাংস ভুনা।

এদিকে পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্ট লেখক, কবি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরাও। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় প্রেসক্লাব, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, ভোলা ও কুমিল্লা জেলা প্রশাসন এবং রায়গঞ্জ উপজেলা প্রশাসন।

মা-ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় ইলিশ ছাড়াই বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবার তারুণ্যের বড় অংশ। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পান্তা ইলিশ বর্জনের আহবান উঠছে। খোলা হয়েছে কয়েকটি পেজ।

এসব পেজে শত শত মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। মার্চ এপ্রিলে এবার আইনীভাবে ইলিশ কেনা-বেচা নিষিদ্ধ করায় তারা একাত্ম হয়ে বলছেন, নিষিদ্ধ ইলিশে নয় পহেলা বৈশাখ।

এদিকে বিগত বছরগুলোতে যারা পান্তা ইলিশের আয়োজন করতেন তারাও এবার পিছু হটেছে এ আয়োজনে। পান্তা ইলিশের বদলে তারা বাঙালির সার্বজনীন এবং সাধ্যতূল্য খাবার বেঁচে নিয়েছে।

‘বৈশাখে ইলিশের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সম্পর্ক নেই’ মন্তব্য করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, গ্রামবাংলায় পহেলা বৈশাখের আয়োজনে থাকতো আগের দিন ভিজিয়ে রাখা চাল। যে চালের পানি কৃষক খেতেন এবং মঙ্গলের জন্য কিষানি কৃষকের শরীরে ছিটিয়ে দিতেন। তারা পান্তাও খেতেন কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, শুঁটকি ভর্তা, বেগুন ভর্তা এসব দিয়ে।

এদিকে বিভিন্ন প্রবন্ধ ও নিবন্ধ থেকে জানা যায়, পহেলা বৈশাখের উত্সবে গ্রামের অবস্থাপন্ন এবং ধনী পরিবারে খাবারের আয়োজনের মধ্যে থাকত চিড়া, মুড়ি, সাধারণ খই, বিভিন্ন ধানের খই, দই, খেজুরের গুড়, খিচুড়ি, বড় কই মাছ, বড় রুই মাছ ইত্যাদি। সকালবেলা নাশতার আয়োজনে থাকত চিড়া, মুড়ি, খই, লুচি, দই, খেজুর গুড় ইত্যাদি।

আর দুপুরবেলা থাকতো খিচুড়ি এবং বড় কই ভাজা, বড় রুই মাছের পেটি ভাজা, বড় পুঁটি মাছ ভাজা এবং বিভিন্ন ধরনের ভাজি। রাতেও এসব খাবার খাওয়া হতো। কিন্তু গ্রামের গরিব বা সাধারণ পরিবারে এমন ধরনের আয়োজন হতো না। তবে তারাও সাধ্যমত উত্সব আয়োজনে মেতে উঠতো।

Facebook Comments Box

সাম্প্রতিক খবর:

কুয়েত ফেরত প্রবাসী মো. সাদ মিয়া আর নেই

বিশেষ অনুমতি ছাড়াই পাওয়া যাবে কুয়েতের ভিসা

চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের স্ত্রী গ্রেপ্তার

আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের

কুয়েতে বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত

কুয়েতের কাজের ভিসার জন্য বাংলাদেশিদের অতিরিক্ত ৩০০ ডলার পর্যন্ত দিতে হচ্ছে

চুরি হওয়া টাকা'ই ঋণের জন্য ব্যবহার হয়

ক্রোধের স্রোত অত্যাচারীদের ধ্বংস করে- আহমেদ আল-জারাল্লাহ

কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশী তরুণ মকবুল হোসেনের সফলতার গল্প

কুয়েতে ঈদুল ফিতর উদযাপিত এবং রাষ্ট্রদূত এর সঙ্গে প্রবাসীদের শুভেচ্ছা বিনিময়

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» কুয়েতে বিজয় দিবস কাপ-২০২৫ এর সেমিফাইনালে উঠেছে নবজাগরণ স্পোর্টিং ক্লাব

» কুয়েত ফেরত প্রবাসী মো. সাদ মিয়া আর নেই

» বাহরাইনে বাংলাদেশ দূতাবাসে বাংলা নববর্ষ উদযাপন

» ফিলিস্তিনের পক্ষে লন্ডনের রাজপথে প্রবাসী বাংলাদেশিরা

» বিশেষ অনুমতি ছাড়াই পাওয়া যাবে কুয়েতের ভিসা

» চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের স্ত্রী গ্রেপ্তার

» আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের

» কুয়েতে জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত

» কুয়েতে বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত

» কুয়েতের কাজের ভিসার জন্য বাংলাদেশিদের অতিরিক্ত ৩০০ ডলার পর্যন্ত দিতে হচ্ছে

Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
,

বৈশাখে ইলিশ খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়, এটা স্রেফ শহুরে ফ্যাশন

আদিত্য আরাফাত::  ইলিশকে উড়ে এনে জুড়ে বসানো হয়েছিলো যেনো বাঙালির সার্বজনীন বৈশাখ উদযাপনে! যদিও বৈশাখে ইলিশ বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়। তবুও নববর্ষ পালনে বাঙালির পাতে যেনো জোর করে চাপানো হয় ইলিশ।

বৈশাখে ইলিশ ভোজনকে যখন বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ বানিয়ে ফেলা হয় তখন অসময়ে শুরু হয় এ মাছটি কেনার মহোৎসব। চাহিদা বেশি থাকায় নির্বিচারে শুরু হয় ইলিশ ধরা। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে প্রজননকালে ইলিশ নিধন হতে থাকে।

এতে সারাবছরে ইলিশ উৎপাদনে প্রভাব পড়ে। এভাবে বৈশাখকে কেন্দ্র করে ইলিশ ধরার উৎসব চললে নিকট অতীতে জাতীয় এ মাছটি হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কাও তৈরি হয়।

এমন শঙ্কার মাঝে কথা উঠে ইলিশ বৈশাখী সংস্কৃতিতে কিভাবে আসলো। হাজার বছরের যে বাঙালি সংস্কৃতি তাতে বৈশাখ পালনে ইলিশ খাওয়া হতো কি-না! বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহকরা ইতিহাস ঘেটে দেখেছেন, নববর্ষ উদযাপনে ইলিশ ভোজন হতো না। নথিপত্র ঘেটে গভীর অনুসন্ধানে তারা দেখেছেন, বৈশাখে ইলিশ খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়। এটা স্রেফ শহুরে ফ্যাশন। নিকট অতীতেই এ ফ্যাশন চালু হয়।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এতোবছর ধরে বাংলা নববর্ষে ইলিশ খাওয়ার রীতি চালু থাকলেও এবার কেন ‘বৈশাখে ইলিশ নয়’ এ কথা উঠছে। মৎস্য গবেষকরা বলছেন, বৈশাখকে কেন্দ্র করে নির্বিচারে শুরু হয় ইলিশ ধরা। ইলিশ মাছ বছরজুড়ে কমবেশি ডিম ছাড়লেও ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল অব্দি ছোট ডিম ছাড়ার পর্ব থাকে।

আর এ সময়ে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে আগে থেকে ছানা ইলিশ নিধন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এভাবে চলতে থাকলে শিগগিরই ইলিশ বিলীন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন গবেষকরা। নদীতে ইলিশের সংখ্যা যেভাবে কমছে তাতে শঙ্কিত হয়ে ঝাটকা না ধরতে পরামর্শ দিয়েছেন। এতো গেলো মৎস্য গবেষকদের কথা।

আর সংস্কৃতি বোদ্ধারা নথিপত্র ঘেটে বলছেন, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশের দূরতম সম্পর্ক নেই। পান্তা ভাতের সঙ্গেও বৈশাখী উৎসবে বাঙালি সংস্কৃতির মিল নেই। প্রান্তিক মানুষরা পান্তাভাত খান স্রেফ নুন আর মরিচ দিয়ে। ইলিশ মাছ তাদের কাছে সাধ্যাতীত বস্তুতুল্য। তাদের সারা দিনের কামাই দিয়ে স্বাভাবিক সময়ে একটা জাটকা মেলে না, পহেলা বৈশাখে ইলিশের স্বপ্ন দূর অস্ত। তাই অনেকে পহেলা বৈশাখের পান্তা-ইলিশকে দেখছেন বাঙালির প্রান্তিক মানুষের প্রতি উপহাস ও ব্যঙ্গ হিসেবে।

সমাজবিজ্ঞানী, সংস্কৃতি বোদ্ধা এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বৈশাখে ইলিশের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সম্পর্ক নেই। পান্তাভাত গরিব মানুষের খাবার। রাতে খাওয়ার পর অবশিষ্ট ভাত রাখার কোনো উপায় ছিল না; তাই পানি দিয়ে রাখা হতো এবং সকালে আলুভর্তা, পোড়া শুকনো মরিচ ইত্যাদি দিয়ে খাওয়া হতো। আমিও ছোটবেলায় খেয়েছি। কিন্তু এখন পান্তা-ইলিশ ধনী লোকের বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে এবং এটা দুর্মূল্যও বটে—যা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এর মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতিকে সম্মান দেখানোর পরিবর্তে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। পান্তাভাত একদিন নয়, সারা বছরই খাওয়া যেতে পারে।

তিনি বলেন, আমাদের ছোটবেলায় পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার প্রচলন ছিল না। আমরা চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় যেতাম এবং বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনতাম। পহেলা বৈশাখে হালখাতার অনুষ্ঠানে যেতাম। তখন এসব অনুষ্ঠান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।

এর মধ্যে কোনো বাণিজ্যিকতা ছিল না। কিন্তু এখানে বৈশাখী অনুষ্ঠানে বাণিজ্যিকতা ঢুকেছে এবং বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে বড়লোকের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, ঢাকার শহুরে বাঙালিদের কেউ কেউ আগপিছ না ভেবে আচমকা পান্তা-ইলিশের চল শুরু করেছিলেন আশির দশকে। ১৯৮৩ সালে ওই বছরই প্রথম রমনা এলাকায় একটি বাণিজ্যিক পান্তাভাতের দোকান দেওয়া হয়। সেই দোকানে অভিনবত্ব আর নাগরিক আভিজাত্য আনতে পান্তার সঙ্গে পরিবেশন করা হয় ভাজা ইলিশের টুকরো।

দোকানের সামনে ব্যানার টাঙ্গিয়ে লেখা হয়, ‘এসো হে বৈশাখ…বৈশাখে পান্তা-ইলিশ ভোজন’। বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হলে অনেকেই পরে তার পেছনে ছোটে। অতএব, এর পর থেকে পান্তা-ইলিশের দোকানের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়তে থাকে। আশির দশকে শহুরে সংস্কৃতিতে পান্তা ইলিশ চালু হলেও নব্বই দশক থেকে এর ব্যাপকতা বাড়ে।

এক পর্যায়ে নববর্ষে পান্তা-ইলিশের ব্যবসা বেশ জেঁকে বসে। মেঘনার অবৈধ ইলিশ শিকারি আর শহরের ফড়িয়া ব্যবসায়ী সবাই পহেলা বৈশাখ ঘিরে ইলিশকেই গড়ে তুলল ব্যবসার প্রধান অনুষঙ্গ। ইলিশের দাম শতকের ঘর ছাড়িয়ে হাজারের ঘরে উঠে গেল।

কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, ইলিশ আমাদের ঐতিহ্যের অংশ তবে বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার রীতি বাঙালি সংস্কৃতিতে ছিলো না। আর পান্তা গ্রামবাংলায় কৃষকের প্রতিদিনেরই খাবার। কিন্তু পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার প্রচলন তাদের মধ্যে নেই।

তিনি বলেন, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লেষহীনতা ছাড়াও এই পান্তা-ইলিশের হেঁয়ালি প্রভাব ফেলছে দেশের ইলিশের বংশবৃদ্ধির ওপর। সময়টা ইলিশের প্রজনন মৌসুম। কিন্তু উচ্চমূল্যের লোভে অনেক ব্যবসায়ী লুকিয়ে ইলিশ শিকার করে ক্ষতির মুখে ফেলছে দেশের এই অনন্য মৎস্যসম্পদকে। Panta_Ilish-650x410এ বছরই পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে ‘বৈশাখে ইলিশ নয়’ স্লোগান জোরালোভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী জাতীয় মাছ ইলিশ রক্ষার স্বার্থে নববর্ষ উদ্‌যাপনের দিন অর্থাৎ পয়েলা বৈশাখ ১৪২৩-এর খাদ্যতালিকায় ইলিশের কোনো আইটেম রাখছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে এ দিনের মেন্যুতে খিচুড়ির সঙ্গে থাকছে বেগুন ভাজি, ডিম ও মুরগির মাংস ভুনা।

এদিকে পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্ট লেখক, কবি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরাও। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় প্রেসক্লাব, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, ভোলা ও কুমিল্লা জেলা প্রশাসন এবং রায়গঞ্জ উপজেলা প্রশাসন।

মা-ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় ইলিশ ছাড়াই বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবার তারুণ্যের বড় অংশ। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পান্তা ইলিশ বর্জনের আহবান উঠছে। খোলা হয়েছে কয়েকটি পেজ।

এসব পেজে শত শত মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। মার্চ এপ্রিলে এবার আইনীভাবে ইলিশ কেনা-বেচা নিষিদ্ধ করায় তারা একাত্ম হয়ে বলছেন, নিষিদ্ধ ইলিশে নয় পহেলা বৈশাখ।

এদিকে বিগত বছরগুলোতে যারা পান্তা ইলিশের আয়োজন করতেন তারাও এবার পিছু হটেছে এ আয়োজনে। পান্তা ইলিশের বদলে তারা বাঙালির সার্বজনীন এবং সাধ্যতূল্য খাবার বেঁচে নিয়েছে।

‘বৈশাখে ইলিশের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সম্পর্ক নেই’ মন্তব্য করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, গ্রামবাংলায় পহেলা বৈশাখের আয়োজনে থাকতো আগের দিন ভিজিয়ে রাখা চাল। যে চালের পানি কৃষক খেতেন এবং মঙ্গলের জন্য কিষানি কৃষকের শরীরে ছিটিয়ে দিতেন। তারা পান্তাও খেতেন কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, শুঁটকি ভর্তা, বেগুন ভর্তা এসব দিয়ে।

এদিকে বিভিন্ন প্রবন্ধ ও নিবন্ধ থেকে জানা যায়, পহেলা বৈশাখের উত্সবে গ্রামের অবস্থাপন্ন এবং ধনী পরিবারে খাবারের আয়োজনের মধ্যে থাকত চিড়া, মুড়ি, সাধারণ খই, বিভিন্ন ধানের খই, দই, খেজুরের গুড়, খিচুড়ি, বড় কই মাছ, বড় রুই মাছ ইত্যাদি। সকালবেলা নাশতার আয়োজনে থাকত চিড়া, মুড়ি, খই, লুচি, দই, খেজুর গুড় ইত্যাদি।

আর দুপুরবেলা থাকতো খিচুড়ি এবং বড় কই ভাজা, বড় রুই মাছের পেটি ভাজা, বড় পুঁটি মাছ ভাজা এবং বিভিন্ন ধরনের ভাজি। রাতেও এসব খাবার খাওয়া হতো। কিন্তু গ্রামের গরিব বা সাধারণ পরিবারে এমন ধরনের আয়োজন হতো না। তবে তারাও সাধ্যমত উত্সব আয়োজনে মেতে উঠতো।

Facebook Comments Box

সাম্প্রতিক খবর:

কুয়েত ফেরত প্রবাসী মো. সাদ মিয়া আর নেই

বিশেষ অনুমতি ছাড়াই পাওয়া যাবে কুয়েতের ভিসা

চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের স্ত্রী গ্রেপ্তার

আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের

কুয়েতে বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত

কুয়েতের কাজের ভিসার জন্য বাংলাদেশিদের অতিরিক্ত ৩০০ ডলার পর্যন্ত দিতে হচ্ছে

চুরি হওয়া টাকা'ই ঋণের জন্য ব্যবহার হয়

ক্রোধের স্রোত অত্যাচারীদের ধ্বংস করে- আহমেদ আল-জারাল্লাহ

কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশী তরুণ মকবুল হোসেনের সফলতার গল্প

কুয়েতে ঈদুল ফিতর উদযাপিত এবং রাষ্ট্রদূত এর সঙ্গে প্রবাসীদের শুভেচ্ছা বিনিময়


এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



Exchange Rate

Exchange Rate EUR: Sat, 24 May.

সর্বশেষ খবর



Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Bangladesh Office

Director. Rumi Begum
Adviser. Advocate Koyes Ahmed
Desk Editor (Dhaka) Saiyedul Islam
44, Probal Housing (4th floor), Ring Road, Mohammadpur,
Dhaka-1207. Bangladesh
Contact: +8801733966556 /+8801316861577

Email Address

agrodristi@gmail.com, agrodristitv@gmail.com

Licence No.

MC- 00158/07      MC- 00032/13

Design & Devaloped BY Popular-IT.Com
error: দুঃখিত! অনুলিপি অনুমোদিত নয়।